বৃহস্পতিবার ১৩ই মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৮শে ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইউএসএ থেকে প্রকাশিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল
সংবাদ এবং তথ্যে আপনার প্রয়োজন মেটাতে

রাজনীতিবিদদের আচরণ কি পাল্টেছে

নিজস্ব প্রতিবেদক   |   শুক্রবার, ১০ জানুয়ারি ২০২৫   |   প্রিন্ট   |   112 বার পঠিত

রাজনীতিবিদদের আচরণ কি পাল্টেছে

পথ চলতে অনেক কিছুই চোখে পড়ে। আমন ধান কাটা শেষ। শর্ষের জমিন হলুদ হচ্ছে। ভোরে ভারী পর্দার মতো কুয়াশা নামে। উত্তুরে হাওয়ায় শীত বসেছে জেঁকে। এর মধ্যে গাছে, ল্যাম্পপোস্টে কিংবা দোকানে ঝুলছে চিরপরিচিত ব্যানার। জনসেবার জন্য মুখিয়ে থাকা লোকেরা জানান দিচ্ছেন, তাঁরা শিগগিরই মাঠে নামবেন।

নির্বাচন কবে হবে জানি না। এ নিয়ে আলোচনা, বিতর্ক ও মাতম চলছে। কিছু দল চায় এখনই নির্বাচন হোক। কিছু দল চায় নির্বাচন হোক রয়েসয়ে। এত তাড়াহুড়ার কী আছে! আমাদের ঘর ভাঙা, নড়বড়ে। তার মেরামত দরকার আগে।

হিসাবটা স্পষ্ট। নির্বাচনে যাঁরা জয়ের আশা করেন, তাঁদের তর সইছে না। অনেকেই চান আরেকটু গুছিয়ে নিতে। যাঁদের হারানোর কিছু নেই, নির্বাচন না হলেও তাঁদের কোনো অসুবিধা নেই। অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচনের সময় ঠিক করা হবে। রাজনীতিবিদেরা একমত হবেন, এমনটি মনে হয় সোনার পাথরবাটি।

যখন জাতীয় সংসদ ছিল, তখন আমরা সব দলের সদস্যদের মধ্যে বিস্ময়কর ঐকমত্য দেখেছি গুটিকয় বিষয়ে। সেসব ছিল তাঁদের নানা ইহজাগতিক প্রাপ্তি নিয়ে। যেমন সংসদ সদস্যদের বেতন-ভাতা বাড়ানো, শুল্ক না দিয়ে গাড়ি আমদানি। অনেকেই কারণে-অকারণে সংসদ অধিবেশন থেকে ওয়াকআউট করেছেন, লাগাতার সংসদ বর্জনের উদাহরণ আছে অনেক। একবার তো বিরোধী দলের সদস্যরা সংসদ থেকে সেই যে বেরিয়ে গেলেন, ফিরে এলেন দুই বছর পর নির্বাচনে জিতে। কিন্তু হাজারো সমস্যায় জেরবার নাগরিকদের দিকে নজর না দিয়ে নিজেদের সুবিধা হবে—এমন প্রস্তাবের প্রতিবাদে কেউ কখনো ওয়াকআউট করেননি।

দেশের সংবিধান ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি—এ দুয়ে মিলে এ দেশে ৩০০ সদস্যের একটি মালিক সমিতি তৈরি হয়েছে। এই সমিতিতে নাম লেখানোর জন্য কত আকুতি, কত আয়োজন। হাওয়া থেকে পাওয়া, ২০২৫–২৬–এর শুকনা মৌসুমে দেশে একটা নির্বাচনের সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। এ নিয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। কিন্তু ব্যানারে ছেয়ে যাচ্ছে দেশ। এসব নিয়ে হতে পারে সচিত্র ব্যানার-সাহিত্য।

ব্যানারগুলোর প্রকৃতিতে মিল আছে। ওপরে এক কোনায় দলের মূল মালিক ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ছবি গোল গোল করে দেওয়া। তার নিচে বড় করে একজনের ছবি। তিনি এলাকার উন্নয়নের চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারেন না। তিনি সবাইকে সালাম জানাচ্ছেন। নিচে ছোট করে আরও দু-একজনের ছবি। তাঁদের নামের পাশে লেখা—সহযোগিতায় অমুক কিংবা সংগ্রামী কর্মী অমুক। মাঝের বড় ছবিওয়ালা ব্যক্তি এমপি হয়ে গেলে ওই সংগ্রামী কর্মীরা ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদে ঢোকার টিকিট পাবেন। সেটি না পেলেও ক্ষতি নেই। চারদিকে উন্নয়নের ছড়াছড়ি। দু-একটা ঠিকাদারি পেলেই বর্তে যাবেন।

কোথাও কোথাও দেখা যায়, কোনো দলের ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, পৌরসভা বা উপজেলা কমিটিতে কোনো সংগ্রামী ভাই বা বোন অমুক পদে দাঁড়িয়েছেন। তিনি সবার দোয়াপ্রার্থী। স্থানীয় পর্যায়ে কোথাও কোথাও দলের কমিটি হচ্ছে। সেখানে দোয়া করার ফুরসত মিলছে না। সেখানে চলছে চেয়ার-ছোড়াছুড়ি, হাতাহাতি, মঞ্চ ভাঙা এবং সেই সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীর হাত-পা ভেঙে দেওয়া। পুলিশ ডেকেও থামানো যাচ্ছে না। এ দেশে প্রথমবারের মতো দেখলাম, পুলিশ মানুষ হয়ে গেছে আর মানুষগুলো হয়ে গেছে পুলিশ।

নির্বাচন উপলক্ষে আকাশে-বাতাসে টাকা ওড়ে। অর্থনীতির ভাষায় এটাকে বলে রিলোকেশন বা মানি ট্রান্সফার। একদল লোকের হাত থেকে আরেক দল লোকের হাতে টাকা যায়। এতে কিছু কর্মসংস্থানও হয়। বেকার যুবকেরা মাস দুয়েক চোঙা ফুঁকে টু-পাইস কামিয়ে নেন। একবার সংসদ ভবনে ঢুকতে পারলে বিনিয়োগের টাকা সুদে-আসলে-উপরিতে শত গুণ উঠে আসে। আমরা জানি, নানান কারণে আমাদের দেশের পরিস্থিতি যথেষ্ট বিনিয়োগবান্ধব নয়। কিন্তু নির্বাচনে বিনিয়োগ খুবই লাভজনক। ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ প্রবচনটির সার্থক প্রয়োগ দেখি নির্বাচনী-বাণিজ্যে। এটাকে আটকানো বা নিয়ন্ত্রণ করার ওষুধ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হাতে নেই।

একটা প্রশ্ন করলেই তো জবাবটা পাওয়া যায়। ভাই, আপনি জনসেবার জন্য এত উতলা কেন? হ্যাঁ, জনসেবার অধিকার একটি মৌলিক অধিকার বটে। সে জন্য নির্বাচন কি অপরিহার্য? নির্বাচন না করে কি জনসেবা করা যায় না? এট ঠিক, নির্বাচিত হলে রাষ্ট্রযন্ত্র ও জনগণের টাকা ব্যবহার করে আরও বেশি সেবা দেওয়া যায়। একই সঙ্গে হাতের মুঠোয় চলে আসে আত্মসেবার সোনার কাঠি। সে জন্যই নির্বাচনের একটা টিকিট পেতে এত দৌড়ঝাঁপ আর বিনিয়োগ। এটা হচ্ছে সাধারণ ছবি। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে।
এখন মালিক সমিতি নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। মালিক ৩০০ জন হলেও মালিকদেরও মালিক আছেন। তিনি দলের মালিক। দলে কে থাকবেন, না থাকবেন, সংসদ সদস্য হিসেবে দলের মনোনয়ন কে পাবেন, সেটি তিনি ঠিক করেন। তাঁকে ঘিরে থাকে অনুগতদের একটি চক্র। নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে তাঁরা বিস্তর বাণিজ্য করেন।

দলের মালিক যাতে তাঁর একচেটিয়া কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পারেন, সে জন্য আমাদের সংবিধানবিশারদদের উর্বর মাথা থেকে বেরিয়ে এসেছে এক অব্যর্থ দাওয়াই—আর্টিকেল-৭০। একটু টুঁ–শব্দ করলেই তাঁর খড়্গ নেমে আসবে গর্দানে। তখন একূল-ওকূল দুই-ই যাবে। দলে ব্যক্তিমালিকানা এবং সংসদে পারিবারিক বা গোষ্ঠীমালিকানা টিকিয়ে রাখার জন্য এর বিকল্প নেই।

কেউ কেউ বলেন, আর্টিকেল-৭০ না থাকলে সংসদ সদস্য কেনাবেচা হবে, স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে এমন অবস্থা হয়েছিল। একবার দেখা গেল, সকালে একটা মন্ত্রিসভা গঠিত হলো, তো বিকেলে দেখা গেল সেটি অস্তাচলে গেছে। উদয় হয়েছে আরেকটি মন্ত্রিসভা। প্রশ্ন হলো, হাটে কেনাবেচা হতে পারেন—এমন লোককে দল কেন টিকিট দেবে আর মানুষই-বা তাঁকে কেন ভোট দেবেন? দলের লোককে এত অবিশ্বাস করলে দল চলবে কীভাবে?

দলের লোক যে কেনাবেচা হয়—এ আশঙ্কা এখনো আছে। মনে আছে, আবার ১৯৮৬ সালে এরশাদের অধীন আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির পাঁচজন নৌকা মার্কা নিয়ে জয় পেয়েছিলেন। পরে তাঁদের মধ্যে দুজন বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে বিএনপির দুজন সংসদ সদস্যকে ভাগিয়ে এনে প্রতিমন্ত্রী করেছিল। কয়েক বছর আগে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘সবাইকে কেনা যায়, আমাকে কেনা যায় না।’ এ উক্তির মধ্যে দুটো সত্য আছে। এক. তাঁর দলের লোকেরা কেনাবেচার পণ্য; দুই. তাঁকে কেনা যায় না, কারণ তিনিই তো মালিক।

নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, ততই নিত্যনতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হবে। রাজনীতি ক্রমাগত সহিংস হবে। দলের টিকিট পেতে যাঁরা মরিয়া, তাঁরা একে অন্যের সঙ্গে সংঘাতে জড়াবেন। শোডাউন, মারামারি, খুনোখুনি হবে। একবার টিকিট পেয়ে গেলে তখন তাঁরা সংঘাতে জড়াবেন প্রতিপক্ষ দলের প্রার্থীর সঙ্গে। সেখানেও চলবে পরস্পরের সমাবেশ ভাঙা, মারামারি, খুনোখুনি। পাঁচ দশক ধরেই এটা চলে আসছে। কোথায় নির্বাচন উৎসবের আমেজ নিয়ে আসবে তা নয়, এটা হবে আতঙ্কের বিষয়।

দেশে একটা বড় রকমের ওলট-পালট ঘটে গেছে। হাজারখানেক লোক প্রাণ দিয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও হাজার হাজার। তো তাঁরা কি গনিমতের মাল? কোনো নেতা তো মারা যাননি। জনসভায় তাঁরা হুংকার দেন—প্রাণ দেব, তবু এটা-ওটা মেনে নেব না। নেতারা প্রাণ দেন না। জাতির প্রয়োজনে তাঁদের নিরাপদে থাকতে হয়। আন্দোলনে কাঁচামালের জোগান দেয় সাধারণ মানুষ।

সভা, সমাবেশ, ব্যানারে সেই চেনা মুখগুলোই ঘুরেফিরে আসছে। এত আন্দোলন, এত বিদ্রোহ, এত প্রাণদানের পরও তাঁদের মুখের ভাষা আর আচরণ বদলায় না। তর্কবিতর্ক হচ্ছে—আগস্টে যা হয়েছে, তা কি অভ্যুত্থান, নাকি বিপ্লব। যার যার মতো করে ব্যাখ্যা-বয়ান চলছে। কিন্তু রাজনীতিবিদদের আচরণ কি পাল্টেছে?

Facebook Comments Box

Posted ১০:২৯ এএম | শুক্রবার, ১০ জানুয়ারি ২০২৫

|

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

ইউএসএ থেকে প্রকাশিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল সংবাদ এবং তথ্যে আপনার প্রয়োজন মেটাতে

NSM Moyeenul Hasan Sajal

Editor & Publisher
Phone: +1(347)6598410
Email: protidinkar@gmail.com, editor@protidinkar.com

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।